অবন্তিকা মামণি,
ভালো আছিস তুই? নিশ্চয়ই ভালো আছিস । তোর মতো চমৎকার একটা মেয়ে খারাপ থাকতে পারে?
জানিস, আমি না প্রায়ই তোর মুখটা মনে করার চেষ্টা করি । কিন্তু কেন যে ঠিক মনে পড়ে না, বুঝে উঠতে পারি না । ছোটবেলায় আমাদের বাসায় কাজ করত যে হাসুর মা, তার চেহারা আমার স্পষ্ট মনে আছে, অথচ তোর মুখটা মনে নেই । এটা কীভাবে সম্ভব! অবশ্য তোর মুখটা মনে করতে গেলে যে একেবারেই কিছু মনে পড়ে না, তা নয় । চোখের সামনে আবছা একটা ছবি স্পষ্ট দেখতে পাই । হ্যাঁ, তোরই ছবি । ছবিটা স্পষ্ট, তোর মুখটা আবছা । এই তুই কিন্তু সেই দুই বছরের তুই না, যে আমি অফিস থেকে বাসায় ফেরার পর নিচতলা থেকে দোতলায় ওঠার সময় সিঁড়িঘর থেকে ‘বাবা!’ বলে চিৎকার করে আমার ঘাড়ে ঝাপিয়ে পড়ত । এই তুই সেই সাড়ে বারো বছরের তুই-ও না, যে এক সন্ধ্যায় বাথরুম থেকে বের হয়ে শোবার ঘরের বিছানায় বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল; আমি কাছে গিয়ে কী হয়েছে জানতে চাইতেই যে আমার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে হু হু করে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, ‘আমার খুব সাংঘাতিক একটা অসুখ হয়েছে, আমি মরে যাব বাবা, আমি মরে যাব!’ সেদিন বাবা হয়েও আমাকেই তোকে সব খুলে বলতে হয়েছিল, সব বুঝিয়ে দিতে হয়েছিল । কী করব বল, তোর মা ছিল না যে!
আমার তোর যে ছবিটার কথা মনে পড়ে সেটা ষোল বছরের তুই । সেদিন তোর মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বের হবার কথা । সারাদিন কী সাংঘাতিক দুশ্চিন্তা, কী মানসিক চাপ! ফল কেমন হবে, পাশ করবি কি না, পাশ করলে ভালো করবি কি না, ভালো করলে কতটুকু ভালো করবি—একটার পর একটা চিন্তা জুড়ে শিকলটা কেবল লম্বা হচ্ছিল । নাহ্, সকাল থেকে এক ফোঁটাও কাজে মন বসাতে পারলাম না । যা-ই করতে যাই, দুশ্চিন্তারা কই মাছের ঝাঁকের মতো চতুর্দিক থেকে আমাকে ঝেঁকে ধরে । দুটো মিটিং ক্যান্সেল করে দিলাম, একটা কারখানায় পরিদর্শনে যাওয়ার কথা ছিল, তা-ও বাতিল করলাম । বিকেলের দিকে খবর এল, ফল বের হয়েছে, তুই পাশ করেছিস । শুধু পাশই করিসনি, সব বিষয়ে জিপিএ পাঁচ; সাথে উপরিপাওনা হিসেবে সরকারের একটা ট্যালেন্টপুলের বৃত্তিও আছে । আমি আনন্দে নাচতে নাচতে ফুল, চকলেট, মিষ্টি নিয়ে বাসায় ফিরলাম । তোর শোবার ঘরে গিয়ে তোকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে চমকে দেব, ঠিক সেই সময় তুই চরকির মতো পাক খেয়ে ঘুরলি, থমথমে গলায় বললি, ‘তুমি আসলে কে?’
আমি থতমত খেয়ে গেলাম । হিসেব তো মিলছে না, এমন তো হবার কথা নয়; তোর মুখে হাসি থাকার কথা, আছে দু’চোখে পানি । যে মুখটা আনন্দে উচ্ছল থাকার কথা, সেটা চাপা আক্রোশে থমথমে । চোখে-মুখে উচ্ছ্বাসের হলদে রঙ থাকার কথা, সেখানে বেদনার নীল আর অবিশ্বাসের লাল একত্র হয়ে কেমন বেগুনি হয়ে আছে ।
সেই হিসেব না-মেলা তুই জানতে চাইছিস, আমি কে । আসলেই তো, আমি কে? আমি শিল্পপতি সরাফউদ্দিন আহমেদ, শ’কোটি টাকার মালিক সরাফউদ্দিন আহমেদ, দু’হাতের আঙুলে যার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা গুণে শেষ করা যায় না সেই সরাফউদ্দিন আহমেদ; কিন্তু ওসব তো আমার বাইরের পরিচয়, ঘরে তো আমি শুধুই তোর বাবা । সেই কথাটা মুখ ফুটে বলতেই তুই চিৎকার করে উঠলি, ‘মিথ্যে কথা! ভুল কথা! ইউ লায়ার!’
আমি দু’পা এগিয়ে গেলাম, ‘কী হয়েছে তোর মা? খুলে বল আমাকে...তুই আমার সাথে মজা করছিস না তো?’
‘খবরদার, আমার কাছে আসবে না! ইউ আর অ্যা চিটার, এতগুলো বছর ধরে আমাকে মিথ্যে বলে এসেছ তুমি! খবরদার, আর এক পা-ও এগোবে না আমার দিকে ।’ বলেই তুই কাঁদতে কাঁদতে আমাকে ধাক্কা দিয়ে এক দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলি । তোর ড্রেসিং টেবিলে পড়ে রইল খোলা একটা প্যাকেট আর একটা খাম । কাছে গিয়ে দেখলাম, আমেরিকার ঠিকানা । ও, এই তাহলে ব্যাপার! আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম । কোকিল তার স্বরূপ চিনে গেছে, কাকের বাসায় তার আর ভালো লাগবে কেন?
সেই রাতেই আমার অজান্তে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলি তুই । আমি জানতাম না, জানলেও বোধহয় আটকাতাম না । আটকে কী লাভ?
ভাবতে অবাক লাগে না, যে আমি একটা দিন তোকে না দেখে থাকতে পারতাম না, একটা রাত তোকে না দেখলে ঘুম হতো না, ব্যবসার কাজে বাইরে গেলে পর্যন্ত তোকে সাথে নিয়ে যেতাম; সেই আমি আটটা বছর ধরে তোকে দেখিনি? এমনকি কোথায় আছিস, কেমন আছিস সেটা পর্যন্ত কখনো জানার চেষ্টা করিনি । যতবারই ভাবতে গেছি ততবারই মনে হয়েছে, পরিচয়হীনা তার ঠিকানা জেনে গেছে, দিকহারা নৌকা পেয়ে গেছে দিকের সন্ধান; এখন শুধু তীরে সেই নৌকা ভেড়ার অপেক্ষা, মাঝখান থেকে আমি কেন যাব হংস মধ্যে বক যথা হতে? আমার কি দায়?
তবু দায় নেই বললেই তো সব দায় এড়ানো যায় না । আমি এতগুলো বছর ধরে তোকে ঠকিয়ে গেছি, কাঠগড়ায় তো আমাকে উঠতেই হবে । জবাবদিহিও করতে হবে । এভাবে আর কতদিন পালিয়ে বেড়াব?
ইশতিয়াক নামে আমার কলেজের একজন বন্ধু ছিল । প্রাণের বন্ধু বলতে যা বোঝায়, তা-ই । কলেজজীবন শেষ হয়ে গেল, আমাদের বন্ধুত্ব শেষ হলো না । ইশতিয়াক তার জীবনের সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় আমাকে স্মরণ করে, আমিও তেমনি তাকে ডাকি প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে । ইশতিয়াক বিয়ে করল, বিয়ের বছরখানেকের মাথায় ঘর আলো করে এল তার ফুটফুটে একটা সন্তান । এত সুখের ঘর ছিল ওদের, হঠাৎ করে কী থেকে কী হয়ে গেল; দু’জনের মতের অমিল একসময় মনোমালিন্যে রূপ নিল, মনোমালিন্য একদিন ঝগড়ায় গিয়ে পৌঁছল, আর সেই ঝগড়া বিচ্ছেদে গিয়ে থামল । চমৎকার দু’জন মানুষ শুধুমাত্র ব্যক্তিগত অহংবোধ বজায় রাখতে কুৎসিত একটা খেলায় নামল । আদালতে মামলা উঠল; বাচ্চা কার কাছে থাকবে তা নিয়ে দু’পক্ষ জোর যুক্তিতর্ক চালাল । কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, মামলার রায় বেরোনোর আগেই ইশতিয়াকটা হুট করে মরে গেল । ওর স্ত্রী অনিমা ততদিনে আমেরিকা প্রবাসী এক ভদ্রলোককে বিয়ে করে ফেলেছে, ওর ভিসাও হয়ে গেছে । কিন্তু আপাতত যাবে শুধু সে একা । সাড়ে আট মাসের ছোট বাচ্চাকে সে কোথায়, কার কাছে রেখে যাবে? পরিচিত কেউ দায়িত্ব নিতে চাইছে না । অনিমা একদিন আমার বাসায় এল, অনুনয়ের সুরে বলল, ‘সরাফ ভাই, আপনি অন্তত কিছুদিনের জন্য মেয়েটাকে রাখুন । আপনি আছেন, খালাম্মা আছেন, আমি জানি ইশতিয়াকের মেয়ে কোনোদিন আপনাদের কাছে খারাপ থাকবে না । আমি বছরখানেক পর সব প্রসেস সম্পূর্ণ করে ওকে আমার কাছে নিয়ে যাব ।’ আমি না করতে পারলাম না ।
বছরখানেক পর সত্যি সত্যি অনিমার চিঠি এসেছিল । ততদিনে আমার মা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন । আমার পৃথিবীতে তখন শুধু আমি আর ওই দেড় বছরের চড়ুই পাখিটা । ওকে ছেড়ে আমি কীভাবে থাকব? আমি অনিমাকে চিঠির জবাবে লিখলাম, ‘...গতমাসে ফরিদপুর থেকে ঢাকায় আসার পথে লঞ্চডুবিতে আমরা তিনজনই মরতে বসেছিলাম । ভাগ্যের জোরে আমি ফিরে এসেছি কিন্তু মা আর তোমার মেয়ে ফিরতে পারেনি । দু’জনেরই কবর হয়েছে আজিমপুরে...।’ অনিমা সেই যাত্রায় ঢাকায় এসে আজিমপুর কবরস্থানে তার মেয়ের কবর জিয়ারত করে গিয়েছিল ।
তারপর?...তারপরের গল্পটা তো তোর জানা । বলে কী হবে? তার চেয়ে বল তো দেখি মামণি, ‘আদুর বাদুড় চালতা বাদুড়, কলাবাদুড়ের বে...’ এর পরের লাইনটা কী? দেখি তোর কতটুকু মনে আছে ।
এই চিঠিটার সাথে একটা অপ্রয়োজনীয় কাগজও পাঠালাম । তিনশ’ টাকা মূল্যের একটা কাগজ । অনেকদিন আগে আমি তোর জীবনের একটা বিশাল ক্ষতি করে দিয়েছিলাম, সেই ক্ষতির তো আর ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব না, তবু যৎসামান্যও যদি পূরণ করা যায়! তেমন কিছু লেখাও নেই ও-তে; শুধু আমার কলাবাগানের বাড়িটার নাম-ঠিকানা লেখা । কিন্তু কলাবাদুড়ের বে’র চাইতে তো আর কলাবাগানের বাড়ির কাগজপত্র গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না, তাই না?
ইতি—তোর কেউ না
চিঠিটা অনেকক্ষণ ধরে নাড়াচাড়া করে দেখল অবন্তিকা । সেই মাখন রঙের কাগজ, সেই কাগজে বেলী ফুলের গন্ধ; বাবার প্রিয় লেখার প্যাড থেকে ছিঁড়ে নেওয়া । ওই প্যাডটা বাবা যেবার অবন্তিকাকে নিয়ে দার্জিলিং গিয়েছিল, সেবারই কিনে এনেছিল; সেটা সেই কত বছর আগের কথা । সেই প্যাডটাকেও এত যত্ন করে রাখলে বাবা, আর নিজের মেয়েটাকে নিজের কাছে রাখতে পারলে না? জোর দিয়ে বলতে পারলে না, তুই আমার মেয়ে । শুধু আমার মেয়ে । তোর কোথাও যাওয়া চলবে না । কেন পারলে না বাবা, কেন পারলে না?
সামনে দাঁড়ানো ভদ্রলোকের দিকে ফিরল অবন্তিকা, ‘আপনি কে?’
‘স্যারের ট্রাস্টের সেক্রেটারি ।’
‘আপনার স্যার এখন কেমন আছেন?’
‘উনি গতমাসে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন । উইলে মৃত্যুর পর আপনার কাছে এই খামটা পৌঁছে দিতে বলা হয়েছিল, দিয়ে গেলাম । আজ আমি আসি ।’